ওঠ বাবা ওঠ। এই নিয়ে মোট পাঁচবার আসলাম। আজকে তোর কি হয়েছে বলতো। আমার সাহিত্যে আলো নেই। থাকবে কোথা থেকে। দু-এক দিন স্কুলের বারান্দায় গিয়েছিলাম। একদিন হঠাত বাবা দেখে ফেলে। সেদিন থেকেই পড়ালেখার ইতি টানা। যাহোক এগুলি আবার তোর বাবা শুনলে কপালে কি না জানি বিপদ ঘটে। তারা এটাতে বিশ্বাসী যে মেয়েদের পড়ালেখা করতে নেই। ঘরের লক্ষ্মী ঘরেই থাকবে। যাজ্ঞে বাদ দে ও সব। আজ আমি পড়তে পারলে তোকে ছড়া শুনিয়ে ঘুম পারিয়ে দিতাম, বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ সললেল্লাহু আলাইহি ওয়াসসল্লামের জীবনী শোনাতাম। তোর কপালে হাত বুলিয়ে প্রভাতের কবিতা শুনিয়ে ডেকে তুলতাম। শুনেছি সুখ-দুঃখ, মায়া-মমতা ভালোবাসা দিয়ে ভরপুর এই বাংলা সাহিত্য। তার কোনটাই ভাগ্যে জুটল না জীবনে। যাহোক এবার তো উঠবি। ঘড়িতে চোখ দিয়েছিস। ক’টা বাজে মা। সাতটা। ওঠ বাবা। শোনামানিক জাদু আমার। হোটেলে যা। ফজরের নামায থেকে তোর বাবা এখনও ফিরেনি। এসে বাড়িতে দেখলে তোকে মেরেই ফেলবে। একদিন না গেলে দশ টাকা কেটে ফেলে তোর মহাজন। মাত্র তিনশ টাকা মাইনে। মাস শেষে দুইশত আশি টাকা তোর বাবার হাতে দিতে হয়। দিতে না পারলে দু দিন খাওয়া বন্ধ। আজকে আমার মোটেও ভাল লাগছে না মা। কত আর ম্যনেজারের কাছে মিথ্যে অজুহাত দিব। কোনদিন পেটব্যাথা, কোনদিন মাথাব্যাথা। কতই বা আর পালিয়ে বেড়াবো। এভাবে আর কত স্কুলে যাবো। স্যার বলেছেন নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে পঞ্চম শ্রেণী পাশ হবে না। জানো মা আমার খুব পড়তে ইচ্ছে করে। পড়াশুনা করবো। ডাক্তার হব। ছি ছি বাবা এগুলি বলে না। এগুলি মুখে আনতে নাই। তোর বাবা শুনলে মা ও ছেলে দুজনকেই মেরে ফেলবে। পড়াশুনা টাকা নষ্ট ছাড়া কিছুই না। মুখ কালো করে করতে লাগলাম কিভাবে হোটেলে ঢুকবো। মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। পেছনের দরজা। ঠক ঠক ঠক। আনিস ভাই...আনিস ভাই......ফিস ফিস করে ডাকতে লাগলাম। কে? আমি। আনিস ভাই আমি রাহমান। আজকেও ভুল করলাম। আমি আব্দুর রাহ্মান। গত জুম্মায় হুজুর বলেছিল আব্দুর অর্থ বান্দা ও রহমান অর্থ দয়াময়। সুতারাং আব্দুর রহমান মানে দয়াময়ের বান্দা। শুধু রহমান আল্লাহ্র নাম। তাই ডাকতে নিষেধ। কিরে এত দেরি কেন? পরে বলছি। দরজাটা তাড়াতাড়ি খোলো আগে। আমি সরাসরিই কাজে যোগ দিলাম কিন্তু কাজে যোগ দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ম্যানেজারের ডাক- আব্দুর রহমান... জ্বি হুজুর। এদিকে আয়..। জ্বি আচ্ছা। ভয়ে বুক কেঁপে উঠল আমার। আজকে কি ব্যাথা ছিল? প্রথমে উত্তর করতে সাহস পাচ্ছিলাম না। বির বির করে বলতে লাগলাম- না মানে আমি খুব অসুস্থ। কি হয়েছে তোর। পুরোটাই তো দেখছি ঠিক আছিস। মনটা খুব খারাপ। বেয়াদব। তোদের আবার মন আছে নাকি। তাছাড়া মন খারাপ থাকলে কি তাকে অসুস্থ বলে? আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল না। তার পরেও বলে উঠলাম- জ্বি। শরীরের রোগের পূর্বাভাস হল এই মনের রোগ। টেনশন থেকে মন খারাপ হয়। মন খারাপ হলে খেতে ইচ্ছে করে না। খেতে ইচ্ছে না করলে শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে মানুষ অসুস্থ হয়ে পরে। আর এটাকেই রোগ বলে। ছোট মুখে বড় কথা। আজকাল নিজেকে দেখি আইনস্টাইন ভাবা শুরু করছিস। অর্ধদিবস বেতন কেটে দিচ্ছি। এরপর এমন হলে সেদিন হবে এই হোটেলে তোর শেষ দিন। কুচকুচে অন্ধকার। আজকে খুব একটা ভাল লাগছে না। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর রাতের অন্ধকারে আব্দুল হামিদ চাচার কক্ষের পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে পড়া শুনি। বদ্ধ এই গ্রামে শিক্ষিত লোক বলতে একমাত্র আব্দুল হামিদ চাচা। লোকটা দেখতে গম্ভীর হলেও বেশ নরম স্বভাবের। হিংসা-বিতাকাতি,পরনিন্দা, মারামারি-কাটাকাটিতে একদম নেই। সমাজের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে পাওয়া যায় এই লোকটিকে। বিশ্ববিদ্যালয় নামটি শুনেছি ওনার পরিবার থেকেই। তার চার ছেলেমেয়ের বড় দুই ছেলেই পড়ে ঢাকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। মানুষ যখন জমি-জমা, ঘর-বাড়ি, আসবাবপত্র নিয়ে ব্যাস্ত, তখন তিনি ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া নিয়ে ব্যাস্ত। দেখিনি কখনো কিন্তু শুনেছি লক্ষ লক্ষ টাকা দিতে হয় নাকি ঐ বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে। কি জানে বাপু এত টাকা যে মানুষ কি করে। মাঝে মাঝে দু-একজনের মুখে শুনি আব্দুল হামিদ সাহেবের টাকা বেশী হয়েছে তো তাই নষ্ট করছে। সরকারি চাকুরী করলেও মানুষটির ভিতরে কেমন যেন অপূর্ণতা কাজ করে। আমি ওনাকে খুব খেয়াল রাখি। কেননা সবাই বলে ওনার মত লোক চার গ্রামে খুঁজেও নাকি পাওয়া যায় না। ভোর সকালে ফজর থেকে এসেই শুরু হয় ডাকাডাকি। আব্দুর রউফ, আব্দুল বারী... ওঠ বাবা, সকাল হয়েছে। পড়তে বস। পড়ালেখার মাঝে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে মাঝে মাঝে বলে---আমি টাকার অভাবে বেশী দূর যেতে পারি নাই। বি এস সি ফেল। তাই আল্লাহ্র কাছে দোয়া করি তোদের যেন আমার মত অবস্থা না হয়। ভাবতে ভাবতে চোখে ঘুম ভর করল। কয়েকটি চোখ টিপও মেরেছি। ভাবছি শুয়ে পড়বো। কিন্তু তা আর হল না। হঠাত মায়ের ডাক। পাশে এসে বসল মা। ফিস ফিস করে বলল- তুই বড় হয়েছিস। তোর বাবা ভাবছে সামনের বছর তোকে ঢাকায় পাঠাবে। অভাবি সংসার। এভাবে আর কত। তিনশ না গার্মেন্টসে তিনহাজার করে পাবি। জাহিদ, জামিল ওদের কাছ থেকে শুনেছি। আচ্ছা মা তুমি এখন জাও। আমার ভাল লাগছে না। আমি ঘুমাবো। প্লিজ যাও। মনটা খুব খারাপ ছিল। ভাবছিলাম তাড়াতাড়ি ঘুমাবো। তা আর হল না। টেনশন এর উপর টেনশন। এভাবে কি ভাল থাকা যায়। সামনের মাসে আমার সমাপনী পরীক্ষা। ঘুম বাদ দিয়ে আবার ভাবতে লাগলাম কি করা যায়। ডিসেম্বর আসতে আর মাত্র দুদিন। আমাকে ঢাকা পাঠানোর জন্য বাবার প্রস্তুতি শেষ বললেই চলে। এক তারিখ জেলেকা চাচি ও তার দুই ছেলে ঢাকায় যাবে। ওদের ছুটি শেষ। বাবা আমার জন্যও টিকিট নিয়ে এসেছে। জীবনের প্রথম দেখলাম ঢাকার বাসের টিকিট। পৃথিবীর মানুষগুলি কেন এত নিষ্ঠুর হয় কেউ রাখে না কারো হৃদয়ের খবর। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো আমার বাবা যদি আব্দুল হামিদ চাচা হত। পাঁচ তারিখ আমার পরীক্ষা শুরু। একবার ভাবলাম অসুস্থতার ভান ধরবো, আরেকবার হোটেল থেকে বাড়ি ফিরব না। চলে যাবো অজানার উদ্দেশ্যে। না তাহলে ডাক্তার হব কি করে। বুদ্ধি একটা বের করতেই হবে। অবশেষে আমার বন্ধু নাফিসকে সব খুলে বললাম। আমারও প্রস্তুতি শেষ। সকাল হাওয়ার আগেই দরজা খুলে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলাম। আমাদের বাড়ি থেকে স্কুল একটু দূরে ছিল। তাই সমস্যা হল না। এই মাসের টাকাটা বাবাকে দেই নি। সারাদিন কখনো স্কুলের বারান্দায়, কখনো রাস্তার ধারে, আবার কখনো গাছের নিছে পড়তে লাগলাম। নাফিস একা একটা কক্ষে থাকত। রাতে ওর কাছে চলে যেতাম। একসাথে পড়তাম দরজা বন্ধ করে। ওর মা ডাকলে আমি খাটের নিচে ঢুকতাম। স্কুল থেকে ফিরতে একদিন কানে আসলো মাইকের আওয়াজ আব্দুর রহমান নামে একটি ছেলে হারিয়ে গেছে...। পরীক্ষা শেষে বাড়িতে ফিরতেই মা বুকে জড়িয়ে নিলো। কাঁদতে লাগলো। বলল এতদিন তুই কোথায় ছিলি আমার বুকটা খালি করে......। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। বাবার কোন পরিবর্তন নেই। পেটের কাছে মিষ্টি কথার দাম নেই। হয়তো তাই। দুই গালে কষে চর বসিয়ে দিল আমার। আর বলল টিকিটের একশত পঞ্চাশ টাকা ফেরত দে। প্রথমে এসে খুব খারাপ লাগলেও এখন বেশ ভাল লাগছে। ঢাকার জীবনটা খুব ব্যস্ততায় কাটছে। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত অফিস করলে সময় থাকবে কিভাবে। রাত দশটা। ভাবলাম মাকে একটা চিঠি লিখব। কিন্তু পাঠাব কিভাবে। প্রিয় মা, আমার সালাম নিও, আসসালামুয়ালাইকুম ওআরহমাতুল্লাহ। আমি অনেক ভাল আছি মা। এখানে আমাকে সবাই অনেক আদর করে। আচ্ছা মা তুমি কেমন আছো। আমার উপর রাগ করে আছো বুঝি। তোমার বুক খালি করে আমি সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছি। আমার রেজাল্ট সাতাশ তারিখ। আমার রেজাল্ট শুনে আমাকে চিঠি দিও। ইতি, তোমার কলিজার টুকরা দু মাস পেরিয়ে গেল। মায়ের চিঠি আসলো না। জামিল ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠল তোকে তো বলাই হয় নি, তোর চিঠিটা পাঠানো হয় নি রে। তুই দেয়ার পর কোথায় যে রাখলাম। খুজেই পেলাম না। যার ব্যথা সে বুঝে। কারো কাছে সাদা কাগজ, করো কাছে সেটাই মনি মুক্তা। আজ খুব ভাল লাগছে। আমার ম্যানেজার বলেছে ঈদের পর আমার প্রমোশন, সুপারভাইজার। প্রায় এক বছর পর বাসায় যাচ্ছি। ব্যাগ রেখেই প্রথমে দৌড়ে গেলাম নাফিসের বাসায়। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে রীতিমতো কাদল। আমি জয়ী হতে পারি নি , তুই জয়ী হয়েছিস। তুই জি পি এ পাঁচ পেয়েছিস।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
প্রথমে অশেষ ধন্যবাদ ক্ষুদে মানুষটির গল্পটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য। এই বানানটি অনেক চেষ্টা করেছিলাম আমার ল্যপটপ আসলোই না। ভাবলাম পাঠক বুঝে নিবে। তবে মুহাম্মাদ বানানটি মোহাম্মাদ হতে পারে। একটু দেখবেন প্লিজ। আল্লাহ্ আমাদের মাফ করুন। দোয়ার দরখাস্ত।
দোয়ার দরখাস্ত mosaraf vai আল্লাহ্ যেন হাত দুটি বন্ধ করে না দেয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেন লিখে যেতে পারি। সমাজকে যেন কিছু উপহার দেয়ার তওফিক আল্লাহ্ দেয়।/
মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। গল্পটা অসমাপ্ত ঠিক তা না, তার পড়ালেখার অসমাপ্ত , তার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া অসমাপ্ত। তাই আর সমাপ্ত করার প্রয়োজন মনে করি নাই ভাই।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।